বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৩ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

আজ বিশ্ব হর্সশো ক্র্যাব ডে: সুনীল অর্থনীতির স্বপ্ন

বিশেষ প্রতিবেদক :
বঙ্গোপসাগরের একমাত্র জীবন্ত জীবাস্ম হর্সশো ক্র্যাব বা রাজকাঁকড়াকে ঘিরে দেশের সুনীল অর্থনীতিতে জেগেছে নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। ইতোমধ্যে এ প্রাণীর ওষুধী গুণাগুণ কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ও জৈবপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে দেশে প্রথমবারের মতো গবেষণা শুরু হয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট এর উদ্যোগে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে মানুষের আচরণের কারণে দেশের এ মূল্যবান প্রাণীটি প্রকৃতিতে পড়েছে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।
প্রতিমাসে হাজার হাজার রাজকাঁকড়া মারা পড়ছে জেলেদের জালে। এ প্রাণী রক্ষায় গণসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট এর উদ্যোগে আজ ২০ জুন প্রথমবারের মতো দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে পালন করা হচ্ছে তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল হর্সশো ক্র্যাব ডে বা বিশ্ব রাজকাঁকড়া দিবস।
চিকিৎসা শাস্ত্রে রাজ কাঁকড়ার নীল রক্ত এক যাদুকরী বৈপ্ল¬বিক পরিবর্তন এনেছে। এছাড়া এর শরীরের পেছনে থাকা ছোট্ট লেজটি দিয়ে তৈরি করা হয় ক্যান্সারের মহা ওষুধ। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে একেকটি রাজ কাঁকড়ার দাম পনের থেকে বিশ লক্ষ টাকা। এর এক গ্যালন রক্তের দাম অন্তত ৭০ হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী মূদ্রায় হয় প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকা।
সম্প্রতি করোনা ভ্যাকসিন তৈরীতেও রাজ কাঁকড়ার নীল রক্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী  প্রাণীটি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রাণীটিকে বাঁচাতে ২০২০ সালের ২০ জুন থেকে এই দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হচ্ছে। এক সময় দেশের বঙ্গোপসাগর উপকুলে রাজকাঁকড়ার ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে এর প্রাচ‚র্য কমে আসে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন উপকুলের নদী ও নদীমোহনায় অবৈধভাবে বসানো বিহিন্দি জালে প্রতিদিন হাজার হাজার রাজকাঁকড়া আটকা পড়ার পর মারা পড়ছে বলে জানান রাজকাঁকড়া রক্ষায় গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘হর্সশো ক্র্যাব কনজার্ভেশন গ্রুপ, বাংলাদেশ’।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও টিম লিডার আহমদ গিয়াস জানান, অযত্নে-অবহেলায় দেশের বিভিন্ন উপকুলে প্রতিদিন হাজার রাজকাঁকড়া মারা পড়ছে। এরমধ্যে কেবল বাঁকখালী নদীর কক্সবাজার শহরের মাঝিরঘাট থেকে নাজিরারটেক সমুদ্র মোহনা এবং মহেশখালী চ্যানেলের মুদিরছড়া পর্যন্ত মাত্র ১০ কিলোমিটার এলাকায় ১২টি বিহিন্দি জালে মারা পড়ছে প্রতি মাসে প্রায় দেড় লাখ রাজকাঁকড়া। যার অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ মাসে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর পরিবেশগত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণতো হবে আরো অনেক অনেক বেশি।
সূংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই প্রাণীটি ‘দিয় কিঁয়ারা’ বা দৈত্য কাঁকড়া নামেই সমধিক পরিচিত।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন এর পর্যবেক্ষণেও বাংলাদেশের পরিবেশে ঝুঁকির হার বিবেচনায় প্রাণীটির অবস্থান লাল তালিকায়। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের সর্বশেষ তফসিলে গতবছর রাজকাঁকড়াকে  সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ আইন অনুসারে এই প্রজাতির প্রাণী শিকার, বিক্রয় ও বিপণন বাংলাদেশের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তবে এই আইনটির প্রয়োগ করা হচ্ছে না অভিযোগ করেন ‘হর্সশো ক্র্যাব কনজার্ভেশন গ্রæপ, বাংলাদেশ’ এর স্বেচ্ছাসেবী মাঈনুদ্দিন হাসান শাহেদ।
রাজকাঁকড়ার মূল্যবান ওষুধী গুণাগুণ কাজে লাগিয়ে দেশের সুনীল অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য দেশে প্রথমবারের মতো গবেষণা শুরু করেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট এর বিজ্ঞানীরা।
ইতোমধ্যে গবেষণা শুরুর পর এক বছরের কাছাকাছি সময় অতিবাহিত হয়েছে এবং এই গবেষণার ফলাফল সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদেরকে অত্যন্ত আশাবাদী করে তুলেছে বলে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট এর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব), সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর।
তিনি জানান, পৃথিবীতে বিদ্যমান চার প্রজাতির হর্সসু ক্র্যাবের মধ্যে তিন প্রজাতির হর্সসু ক্র্যাবই এশিয়াতে পাওয়া যায়। আর আমাদের উপকূলে পাওয়া যায় দুই প্রজাতির হর্সসু ক্র্যাব। হর্সসু ক্র্যাবের রক্ত বহুমূল্যবান। এদের রক্তে তামা বা কপারের উপস্থিতির কারণে রক্তের রং নীল দেখায়। এদের রক্তে হিমোগেøাবিনেরপরিবর্তে হিমোসায়ানিন থাকে। এ কাঁকড়ার রক্তের শ্বেত কনিকার অসাধারণ ক্ষমতা বলে এরা যে কোনও ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। এদের রক্তের সংস্পর্শে ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়া বাঁচতে পারেনা। এমনকি ব্যক্টেরিয়ার এন্ডোটক্সিন (যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর) এদের রক্তের সংস্পর্শে কার্যকারিতা হারায়।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট এর মহাপরিচালক আরো জানান, চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশেষ করে ভেকসিন,আই ভি ফ্লুইড ও শিরায় প্রবেশযোগ্য যে কোন জীবন রক্ষাকারী ঔষধ তৈরিতে এদের রক্তের গুরুত্ব অপরিসীম। এমনকি সম্প্রতি আবিস্কৃত কোভিড-১৯ ভেকসিন তৈরীতেও লিমুলাসের নীল রক্তের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
হর্সসু ক্র্যাবের রক্ত থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরী করা হয় লিমুলাস অ্যামিবায়োসাইট লাইসেট (খরসঁষঁং অসবনড়পুঃব খুংধঃব)। যা সংক্ষেপে খঅখ (এলএএল) নামে পরিচিত। ভেকসিনসহ মানবদেহের পেশী বা শিরায় প্রয়োগের জন্য যে কোন ঔষধ প্রস্তুতকালে কিংবা কৃত্রিম অঙ্গ বা যন্ত্র প্রতিস্থাপন করতে হলে মানব দেহে এসব পুরোপুরি নিরাপদ কীনা তা এলএএল টেস্ট ‘খঅখ ঞবংঃ’ এর মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয়।
তিনি জানান, আমেরিকা, চায়না, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে হর্সসু ক্র্যাব হতে বাণিজ্যিকভাবে এলএএল (খরসঁষঁং অসবনড়পুঃব খুংধঃব) উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়। অবশ্য এশিয়ান হর্সসু ক্র্যাব থেকে উৎপাদিত লাইসেট টিএএল বা ঞধপযুঢ়ষবঁং অসবনড়পুঃব খুংধঃব(ঞঅখ) নামে বাজারে পরিচিত।
কক্সবাজারস্থ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) এর সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্র প্রধান ড. শফিকুর রহমান বলেন, রক্তের লোভে সারা বিশ্বে রাজকাঁকড়া নিধন চলছে। আর সেই রাজকাঁকড়ার মৃতদেহ প্রায়শ কক্সবাজার উপকুলে ভেসে আসছে।
তিনি জানান, যাতে প্রাণীটি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে না যায় এবং খামারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করা যায় তারজন্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু করেছেন।
এ প্রাণী রক্ষায় গণসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট এর উদ্যোগে প্রথমবারের মতো আজ ২০ জুন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে পালন করা হচ্ছে তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল হর্সশো ক্র্যাব ডে বা বিশ^ রাজকাঁকড়া দিবস। দিবসের প্রথমভাগে সেমিনার এবং বিকালে শহরের বাঁকখালী নদী থেকে সোনাদিয়া পর্যন্ত রাজকাঁকড়ার বিচরণস্থল পরিদর্শন ও সচেতনতামূলক প্রচারণার কর্মসূচি রয়েছে বলে জানান ইন্সটিটিউটটির মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর।
তিনি জানান, সেমিনারে ভারতের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীসহ দেশের বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞানীরা অংশ নেবেন।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION